করোনাভাইরাসের ঝুঁকি সামলাতে প্রস্তুতি বাড়ছে

সংক্রামক রোগের চিকিৎসার পুরোনো প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। এখানে ধনুষ্টঙ্কার, ডিফথেরিয়া, জলবসন্ত, হাম, এইচআইভি/এইডস, পোলিওর চিকিৎসা হয়। সরকার বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরও চিকিৎসা হবে এখানে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই প্রস্তুতি নিয়েছে।

গতকাল শনিবার দুপুরে এই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকের সামনে রিকশার জটলা। এলাকাবাসী বললেন, এটা রিকশাস্ট্যান্ড। ভেতরে মুড়ি-চানাচুরের ফেরিওয়ালা। ইজিবাইক মেরামত চলছে। পরিবেশ নোংরা। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। কিন্তু এই হাসপাতাল তা মানছে না।

দোতলায় উঠে দেখা গেল, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ভোলানাথ বসাক সহকর্মীদের নিয়ে নতুন ওয়ার্ড প্রস্তুত করার কাজে ব্যস্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওপরের নির্দেশে কাজ হচ্ছে। ১০টি শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চিকিৎসকেরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। হাসপাতালটি ১০০ শয্যার। তবে অর্ধেক শয্যা শূন্য থাকে।

দুই দিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আইসোলেশন বা পৃথক ওয়ার্ড করেছে। এর আগে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একই রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারি সব হাসপাতাল এ ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্ভাব্য সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত। প্রথমত, এই রোগ যেন দেশে ঢুকতে না পারে, তার প্রস্তুতি আছে। ঢুকলে দ্রুত শনাক্ত করার প্রস্তুতি আছে। যদি শনাক্ত হয়ও, চিকিৎসার জন্যও প্রস্তুতি আছে। সংক্রমণ প্রতিরোধের উদ্যোগও আছে।’

তবে দেশের বিভিন্ন বন্দরে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ঢিলেঢালা ব্যবস্থা গতকাল বিরাজমান ছিল বলে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

রংপুর মেডিকেলে ভর্তি একজন

চীনফেরত এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁকে হাসপাতালের ‘আইসোলেশন ওয়ার্ডে’ রাখা হয়েছে। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ঢাকায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানিয়েছে।

করোনাভাইরাস: বন্দরে বন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, তবে ঢিলেঢালাভাব কাটেনি। দেশে ফেরার আকুতি আরও ১৭১ শিক্ষার্থীর।

গত ২৯ জানুয়ারি চীনের আনহুই প্রদেশ থেকে দেশে ফেরেন ওই শিক্ষার্থী। তখন তাঁর শরীরে জ্বর ছিল না। তবে শ্বাসকষ্ট অনুভব করায় গতকাল তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আড়াই বছর আগে ওই শিক্ষার্থী আনহুই প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান।

ওই শিক্ষার্থীর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলের শরীরে জ্বর নেই। তবে কিছুটা অসুস্থতা বোধ করছিল। এ কারণে প্রথমে তাকে সিভিল সার্জনের নির্দেশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সিভিল সার্জন বাড়িতে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে থাকতে বলেন। কোনো পরিবর্তন হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এরই মধ্যে গতকাল শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। সিভিল সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে রংপুর মেডিকেলে পাঠানো হয়।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গঠন করা চার সদস্যের চিকিৎসা দলের প্রধান নারায়ণ চন্দ্র সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না, নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাঁর শ্বাসকষ্ট রয়েছে। হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিষয়টি ঢাকায় রোগতত্ত্ব ও রোগনির্ণয় ইনস্টিটিউটকে জানানো হয়েছে।

দেশে ফেরার আকুতি

চীনের হুবেই প্রদেশে পড়তে যাওয়া ১৭১ জন শিক্ষার্থী দেশে ফিরতে উন্মুখ হয়ে আছেন। আতঙ্কের পাশাপাশি তাঁরা সেখানে খাবারের কষ্টে আছেন। চায়না থ্রি জর্জেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড নিউ এনার্জি বিভাগের ছাত্র ফয়সাল বিন আশহাব জোয়ার্দ্দার তাঁর ফেসবুকে দেশে ফিরে আসার আকুতি জানিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী মাদারীপুরের আশিক হাওলাদার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে থাকা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এক রকম বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাবারের সংকট। তিনি সেখানে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, এ মুহূর্তে তাঁদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, চীনে অবস্থানরত ১৭১ জন বাংলাদেশিকে আনতে বাংলাদেশ বিমানের কোনো উড়োজাহাজ ও ক্রুকে দেশটিতে পাঠানো যাচ্ছে না। ফলে এ মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল থেকে বাংলাদেশিদের আনা সম্ভব হচ্ছে না।

উহানে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা খাবারসহ নানা সংকটে আছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আরও ১৭১ জন এখনো সেখানে আছেন। আমরা তাঁদের আগ্রহের প্রতি খুব সংবেদনশীল। আমরা আগে ৩১২ জনকে আনতে উড়োজাহাজ পাঠিয়েছিলাম। যাঁরা এসেছেন তাঁদের কেউই ভাইরাসে আক্রান্ত নন। প্রথমে এসে তাঁরা খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন, আমরা তাঁদের প্রথম শ্রেণির সেবা দিইনি। পাঁচ তারকা হোটেলে রাখিনি। তাঁদের কেন ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখব? এখন যাঁরা আসতে চান, তাঁদের আনতে গেলে অনেক টাকা খরচ হবে। আমরা তাঁদের আনতে চাই। কিন্তু আমাদের বিমান যেটি আগে গিয়েছিল, তার ক্রুদের সবাই এখন লেইট কোয়ারেন্টাইনে বসে আছেন। এখন তাঁরা কোথাও যেতে চাইছেন না। বিমান কোথাও যেতে চাইছে না।’

বেজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস কী করছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দূতাবাস যোগাযোগ রাখছে। নিয়মিতভাবে তাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার যদি ওদের পয়সা দিয়ে না আনে তবে ৮০ শতাংশই আসবে না। সরকার বিনে পয়সায় নিয়ে আসে, সে জন্য আরেকটু উৎসাহ আছে। তারা এখানে এলে ভালো হয়ে যাবে, এটা ঠিক না।

সব বন্দরে পরীক্ষা

চীন ছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকে যাঁরা দেশে ফিরছেন, তাঁদের সবার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সব এয়ারলাইনসকে লিখিতভাবে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা।

গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন বন্দর হয়ে দেশে আসা ৭ হাজার ৬৫০ জনের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে সন্দেহভাজন কাউকে পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও নিয়ন্ত্রণকক্ষের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে জানান, গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে ২ হাজার ৮৫৩ জন এবং চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে ৭৩ জন দেশে এসেছেন। তাঁদের সবার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। সন্দেহভাজন কাউকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর হয়ে আসা ৬২ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যেও সন্দেহভাজন পাওয়া যায়নি। এর বাইরে বিবিরবাজার স্থলবন্দর, আখাউড়া স্থলবন্দর, বিলোনিয়া স্থলবন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর, ভোমরা স্থলবন্দর ও বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ৫ জন যাত্রী দেশে এসেছেন। তাঁদের সবার পরীক্ষা করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *